আমরা অনেকেই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা ইউরিন ইনফেকশনের সাথে কমবেশী পরিচিত। কারণ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি দেখা যায়। এই সমস্যাটি নারী পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি বেশী দেখা দেয়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কোন রোগ নয় মূলত বিভিন্ন রোগের উপসর্গ। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হলে এই সমস্যা হয়ে থাকে। আবার ছত্রাক বা ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। চলুন জেনে নেই, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার কারণ, লক্ষণ ও ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়া হয় কেন
বিভিন্ন কারণে প্রসাবে জ্বালাপোড়া হতে পারে। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারণে এই ইনফেকশনটি হতে পারে। চলুন জেনে নেই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া কেন হয় সেই সম্পর্কে।
১) প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো অপর্যাপ্ত পানি পান করা অর্থাৎ দেহের চাহিদায় তুলনায় কম পানি পান করা। পানি এমন একটি উপাদান যা আমাদের দেহের বেশীর ভাগ রোগ নিরাময় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে দেহের অভ্যন্তরে নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হয়। শরীরে পর্যাপ্ত পানির অভাবে প্রস্রাবে জ্বলাপোড়া হয়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া সাধারণত তাদের মাঝেই বেশি লক্ষ্য করা যায়, যারা দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান করে না।
২) মহিলাদের ক্ষেত্রে এই উপর্সগটি বেশ বেদনাদায়ক। নারীদের পায়ুপথের খুব কাছেই মূত্রনালী অবস্থিত। যার কারনে পায়ুপথের মাধ্যমে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে।
৩) মহিলাদের প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে মাসিক বা পিরিয়ড। প্রতি মাসেই মহিলাদের মাসিক বা পিরিয়ড হয়। সকলেই পিরিয়ড কালীন সময় ন্যাপকিন বা কাপড় ব্যবহার করে। সেই ন্যাপকিন বা কাপড়ের মাধ্যমেও জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালিতে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণের সৃষ্টি করে।
আবার সঙ্গীর সাথে শারীরিক মেলামেশার ফলেও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হতে পারে। তাই এইসব কারণগুলো বের করে প্রসাবে জ্বালাপোড়া প্রতিকার করা আবশ্যক।
আরো পড়ুনঃ
টনসিল হলে কি কি খাওয়া যাবে না
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ
ইউরিন ইনফেকশনের কিছু কমন উপসর্গ রয়েছে। এই সকল লক্ষণগুলো দেখা দিলেই বুঝে নিতে হবে যে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার সমস্যাটি হচ্ছে।
১) প্রথম যে লক্ষ্মণ দেখা যায় তা হলো প্রস্রাব করার সময় প্রচন্ড পেট ব্যথা অনুভূত হয়। এছাড়া পিঠের নিচেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
২) দ্বিতীয় উপসর্গ হিসেবে যেটা দেখা যায় তা হলো প্রস্রাবের বেগ থাকা স্বত্বেও পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রস্রাবে না হওয়া।
৩) তৃতীয় উপসর্গ হিসেবে দেখা যায় প্রস্রাব এর রং লাল ও ঘোলাটে বর্নের। তাতে তীব্র গন্ধযুক্ত।
প্রসাবে জ্বালাপোড়া কিসের লক্ষণ
প্রসাবে জ্বালাপোড়া অনুভূত হওয়ার পরে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে প্রসাবে জ্বালাপোড়া কিসের লক্ষণ? বড় কোন রোগের উপসর্গ নয় তো? তাদের এই ভয়টি অমুলক নয়। কারন প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ার সাথে কিডনির একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র রয়েছে।
কিডনি বিকল হওয়ার লক্ষ্মণ সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হওয়ার পূর্বে বোঝা যায় না। শরীরে কিছু কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ কিডনি রোগের সংকেত বহন করে। যেমন প্রস্রাব করার সময় জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাব লাল হওয়া, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ, কোমরের দুই পাশে ও তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীর-মুখ ফোলা ইত্যাদি। ফলে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া এর সাথে কিডনি বিকল হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রকাশ করে। তাই দিনের পর দিন এই সমস্যা নিয়ে চলাফেরা করা উচিত না। প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসার মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণ লক্ষণগুলো দেখা দিলে ঘরে বসেই এর প্রতিকার করা সম্ভব। তো, চলুন জেনে নিই প্রসাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রিয় পাঠক উপরের আলোচনা থেকে এতক্ষণ আমরা জানতে পারলাম প্রসাবে জ্বালাপোড়া কেন হয়, প্রসাবে জ্বালাপোড়া এর লক্ষণ, প্রসাবে জ্বালাপোড়া কিসের লক্ষণ সেই সম্পর্কে। এখন আমরা জানব প্রসাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে। তো চলুন জেনে নিই প্রসাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা কি কি রয়েছে সেই বিষয়ে
১) পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা ইউরিন ইনফেকশন রোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পানের কোন বিকল্প নেই। দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান বা তরল জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলে প্রস্রাবের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে প্রস্রাবের সাথে দেহের ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস বের হয়ে যায়। এছাড়া দেহের অভ্যন্তরের জীবাণু সমূহও প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া দূর হয়। দ্রুত প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া নিরাময়ের জন্য উষ্ণ গরম পানি খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
২) শাক-সবজি খাওয়া
প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে সবুজ শাক-সবজি খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। শাক-সবজির মাঝে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা দেহের প্রয়োজনীয় পানির অভাব পূরণ করে। দৈনিক খাদ্য তালিকায় আমিষের পরিমাণ কমিয়ে শাক সবজির পরিমান বাড়াতে হবে । তাছাড়া কিছু কিছু শাক সবজি দেহের শর্করার চাহিদাও মেটায়। তাই প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া রোধকল্পে প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক সবজি খেতে হবে।
৩) গরম চাপ
ইউরিন ইনফেকশন দূর করতে এবং পেট ব্যথা কমাতে সাহায্য করে গরম চাপ। হট ওয়াটার ব্যাগে উষ্ণ গরম পানি ভরে কিংবা কাপড় উষ্ণ গরম করে তলপেট ও এর আশেপাশে এবং পিঠে লাগাতে পারেন। এতে ব্লাডারের উপরের অংশে অতিরিক্ত চাপ কমে যাবে এবং ব্যথাও অনেকটা কমে যাবে। এছাড়াও আজকাল বাজারে হিটিং প্যাড পাওয়া যায়, যা ব্যবহারের মাধ্যমে মাসিকের সময় তলপেটের ব্যথা দূর করা সম্ভব এবং এটি ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয় না। তাই প্রস্রাবে জ্বালাপোড়ায় আক্রান্ত মহিলারা মাসিক বা পিরিয়ডের সময় হিটিং প্যাড ইউজ করতে পারেন। এতে তলপেটের ব্যথা দূর হওয়ার পাশাপাশি প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা ইউরিন ইনফেকশনও দূর হয়ে যাবে।
৪) পানিশূন্যতা দূরিভূত
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী হচ্ছে শরীরে পানিশূন্যতা। মানুষের দেহে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পান না করলে খুব দ্রুত ইউরিন ইনফেকশন হয়ে যায়। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ গ্লাস পানি পান করলে খুব সহজেই প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর হবে। তাছাড়া পানির আধিক্য বিদ্যমান যে সমস্থ ফলে যেমনঃ তরমুজ, আম, আপেল, আঙ্গুর, আনার, নাশপাতি, ডাব ইত্যাদি খেলে পানিশূন্যতা কমে। এছাড়া স্যুপ, নারকেলের পানি, ফলের রস, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি খেলেও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া অনেকটা লাঘব হয়।
৫) দই
প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে দই খুবই কার্যকরী একটি খাবার। মিষ্টি দই এবং টকদই উভয় খাবারেই রয়েছে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া দেহের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং জীবাণু বিনাশ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এছাড়া নিয়মিত দই খাওয়ার ফলে দেহের পিএইচ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ১-২ কাপ পরিমাণ দই রাখলে উপকার হবে।
৬) সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা
স্বামী ও স্ত্রী শারিরীক মেলামেশার আগে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, আপনার সঙ্গীর প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়েছে কিনা। যদি তা হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই মেলামেশা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ সঙ্গীর প্রস্রাবে সংক্রমণ হলে তা আপনারও হতে পারে।
৭) ভেষজ উদ্ভিদ
বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ভেষজ উদ্ভিদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতেও ভেষজ উদ্ভিদ উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে। যেমন নিমপাতার রস, চিরতার রস, আদার রস ও জিরার গুঁড়া মিশিয়ে উষ্ণ গরম পানি মিশিয়ে পান করলেও ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর হয়।
৮) ঘন ঘন সংক্রমণ
ঘন ঘন প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় সংক্রমণ হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক মেয়াদে ও সঠিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
প্রসাবে জ্বালাপোড়া ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে শেষ কথা
প্রচলিত কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে খুব সহজেই প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করা সম্ভব। তাই ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া এর লক্ষ্মণ অনভূত হওয়া মাত্রই উপসর্গটিকে বাড়তে না দিয়ে আজই প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা শুরু করে দিন। কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়া অবধি মেনে চলুন উপরের উপায়গুলো।
0 মন্তব্যসমূহ